বারাণসী, বা বেনারস (যা কাশী নামেও পরিচিত), বিশ্বের প্রাচীনতম শহরগুলির মধ্যে একটি যা এখনও বিদ্যমান। এটি হিন্দু পুরাণে উল্লেখিত পবিত্র শহর গুলির মধ্যে শীর্ষে রয়েছে।
বহু শতাব্দী ধরে, বেনারস (কাশী) এর পবিত্র ভূমি হিন্দুদের জন্য একটি জনপ্রিয় তীর্থস্থান হয়ে এসছে। এটি হিন্দু ধর্মের ধর্মীয় রাজধানী এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য একটি পবিত্র স্থান বলে বিবেচিত হয়।
বেনারসে পবিত্র গঙ্গা নদীর তীরে ৩,৩০০ টিরও বেশি হিন্দু মন্দির, উপাসনালয় এবং ঘাট রয়েছে । গঙ্গা নদী সব পাপ মোচন করে বলে মনে করা হয়। আরো মনে করা হয় যে কাশী বিশ্বনাথের ধামে কেউ দেহ ত্যাগ করলে পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি পায়।
এই নিবন্ধে, আপনি বেনারস শহরে ঘুরে দেখার জন্য নিম্নলিখিত হিন্দু ধর্মীয় স্থানগুলি সম্পর্কে জানতে পারবেন,
- কাশী বিশ্বনাথ মন্দির
- অসি ঘাট
- দশাশ্বমেধ ঘাট
- মণিকর্ণিকা ঘাট
- শ্রী দূর্গা মন্দির
- সঙ্কটমোচন হনুমান মন্দির
তাহলে চলুন এই প্রতিটি জায়গা বিস্তারিতভাবে দেখে নেওয়া যাক।
১. কাশী বিশ্বনাথ মন্দির
কাশী বিশ্বনাথ মন্দির বেনারসের সবচেয়ে পবিত্র স্থানগুলির মধ্যে একটি। এটি উত্তরপ্রদেশের অন্যতম দর্শনীয় মন্দির হিসেবেও বিবেচিত হয়।
এই মন্দিরটি ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে একটি এবং এটি শক্তিশালী ইতিবাচক শক্তি বিকিরণ করতে পরিচিত। এটি গঙ্গার তীরে অবস্থিত এবং ভগবান শিবকে উত্সর্গীকৃত, যিনি এখানে ভগবান বিশ্বেশ্বর অর্থাত্ মহাবিশ্বের প্রভু হিসাবে পূজিত হন।
ভগবান বিশ্বনাথ (বিশ্বেশ্বর) সমস্ত মৃত ব্যক্তিদের আত্মার আশ্রয়স্থল বলে বিশ্বাস করা হয়। মন্দিরের সৌন্দর্য এবং আধ্যাত্মিকতা এখানে আসা প্রত্যেক দর্শনার্থীকে বিস্মিত করেছে বহু যুগ ধরে।
মন্দিরের সোনার গম্বুজ এবং চূড়াটি চমৎকার দেখতে লাগে। মানুষের বিশ্বাস আছে যে তারা যদি এখানে আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করে তবে প্রভু তাদের সমস্ত ইচ্ছা পূরণ করবেন।
২. অসি ঘাট
অসি ঘাট বারাণসীর অন্যতম জনপ্রিয় ঘাট যা পর্যটক এবং স্থানীয়দের সমানভাবে আকর্ষণ করে। এটি বেনারসের দক্ষিণ অংশে অবস্থিত যেখানে গঙ্গা এবং অসি নদী মিলিত হয়েছে।
তীর্থযাত্রীরা আধ্যাত্মিক অনুভূতি অনুভব করতে, বিখ্যাত সন্ধ্যা আরতির সাক্ষী হতে এবং স্থানীয় সংস্কৃতির এক ঝলক দেখতে অসি ঘাট ভ্রমণ করেন।
এই ঘাটটির উল্লেখ রয়েছে বেশ কয়েকটি হিন্দু ধর্মগ্রন্থে, যেমন কুরমা পুরাণ, মৎস্য পুরাণ, পদ্ম পুরাণ এবং অগ্নি পুরাণ। লোকেরা অসি নদীতে পবিত্র ডুব দেয় এবং এখানে ভগবান শিবকে পবিত্র গঙ্গা জল উৎসর্গ করে।
সংক্রান্তি এবং একাদশীর মতো শুভ দিনে, অনেক ভক্ত এই স্থানে পবিত্র স্নান সারেন। এর সাথে জড়িয়ে আছে অনেক পৌরাণিক কাহিনীও। গঙ্গা মহোৎসব এবং মহাশিবরাত্রির সময় ঘাটগুলিতেও ভক্তদের এক বেশ জমজমাট সমাগম থাকে।
৩. দশাশ্বমেধ ঘাট
বারাণসীতে সন্ধ্যাবেলা সময় কাটানোর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক জায়গাগুলির মধ্যে একটি হল দশস্বমেধ ঘাট। এই জায়গাটি জাবতিক সৌন্দর্যে এবং রঙে পরিপূর্ণ। এই স্থানে অনেক ফুল বিক্রেতারা প্রাণবন্ত পুষ্প বিক্রি করে, মাঝি ভাইরা নৌকা পারি দেয় বিশাল নদীর কোলে, এবং সাদা ছাইয়ে আচ্ছাদিত জটাধারী সাধুরা ঘাটে বসে গভীর ধ্যান করেন এবং রুদ্রাক্ষ মালা নিয়ে শিবের নাম জপ করেন। আপনি ঘাটে বসে অনেকক্ষণ বিশ্রাম নিতে পারেন এবং এখানে আসা মানুষের বৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।
প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টায় দশস্বমেধ ঘাটে একটি দর্শনীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গেরুয়া পোশাক পড়া পুরোহিতদের দ্বারা সঞ্চালিত হয় গঙ্গা আরতি। গঙ্গাকে অভিমুখ রেখে বিশালাকৃতির পিতলের পঞ্চপ্রদীপ এর বাতি দেখানো হয়। সাথে কুঁচো গাঁদা ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং এই আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠানের শুরুতে একটি বড় শঙ্খ বাজানো হয়। শঙ্খ, কাঁসর ও ঘণ্টার আওয়াজে বাতাস ভরে যায় ও চারিপাশের আবহাওয়াকে ভক্তিমূলক করে তোলে। সম্পূর্ণরূপে এই অপূর্ব দৃশ্যের কথা আপনি কখনই ভুলতে পারবেন না।
হাজার হাজার ভক্ত এই আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠানের সাক্ষী হতে এবং এর ঐশ্বরিক শক্তি অনুভব করতে সমবেত হন। ঘাটটি এত সুন্দরভাবে আলোকিত হয় যে এই পবিত্র কাজের সম্পূর্ণ প্রতিফলন গঙ্গা নদীতে পড়ে এবং সেই দৃশ্যটি আজীবন মনে রাখার মতো। এই দৃশ্যটির বিভিন্ন কোণ থেকে ছবি তুলতে পারেন এবং অনেকেই নৌকায় চড়ে উপভোগ করেন এই আরতি। মহাবিশ্বকে এক জায়গায় দেখার যে আনন্দ ও সৌন্দর্য তা কেবল এই ঘাট আরতির সঙ্গে তুলনা করা যাবে।
৪. মণিকর্ণিকা ঘাট
পুরীর বিখ্যাত স্বর্গদ্বারের মতো, মণিকর্ণিকা ঘাট ভারতের অন্যতম পবিত্র শ্মশান। মণিকর্ণিকা ঘাটের উৎপত্তি ও ইতিহাসের সাথে অনেক পৌরাণিক কাহিনী জড়িত।
হিন্দুরা বিশ্বাস করে যে এটি মোক্ষ অর্জন এবং পুনর্জন্মের চক্র থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একটি শুভ স্থান। এই ঘাটে ২৪x৭ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চিতা পোড়ানো হয় কারণ এখানে প্রতিদিন অসংখ্য দাহ হয়।
এ এলাকায় ৮০টির বেশি ঘাট রয়েছে। তবে এই পবিত্র স্থানটি পরিত্রাণের চূড়ান্ত গন্তব্য হিসাবে বিবেচিত হয়।
৫. শ্রী দূর্গা মন্দির
অসি ঘাট থেকে অল্প হেঁটে গেলেই দেখতে পাবেন শ্রী দুর্গা মন্দির, যা উত্তর ভারতীয় শৈলীতে বহু-স্তর বিশিষ্ট একটি লাল ইটের মন্দির। এটি একটি ৩০০ বছরের পুরানো মন্দির যা দেবী দুর্গাকে উত্সর্গীকৃত। মনে করা হয় যে তিনি নিজেই এখানে উদ্ভাসিত হয়েছিলেন।
মন্দিরটির ডানদিকে একটি মনোরম পুকুর (দুর্গা কুন্ড নামে পরিচিত) রয়েছে যা পাথরের ধাপ এবং স্তম্ভ সহ এই মন্দিরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।
বানরের দল প্রায়ই এই মন্দিরে আসা যাওয়া করে, এই কারণে এটিকে “Monkey Temple”-ও বলা হয়। মন্দিরের কুন্ডতে কিছু রাজহাঁসও দেখা যায়।
দুর্গা মাতা এখানে বারাণসীর বাসিন্দাদের রক্ষক হিসাবে পূজিত হন।
৬. সংকট মোচন হনুমান মন্দির
সংকট মোচন শ্রী হনুমান মন্দিরটি ১৯০০-এর দশকে স্বাধীনতা সংগ্রামী পণ্ডিত মদন মোহন মালব্য অসি নদীর কাছে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই মন্দিরটি বেনারসের একটি পবিত্র অংশ, কারণ এটি ভগবান হনুমানকে উত্সর্গীকৃত, যিনি সংকট মোচন নামে পরিচিত। মনে করা হয় শ্রী হনুমান সমস্ত পার্থিব ভয় এবং ব্যথা থেকে মুক্তি প্রদান করেন।
মন্দিরে, ভগবান হনুমানের মূর্তিটি তার প্রিয় ভগবান রামের মুখোমুখি আরাধ্য, যাকে তিনি অত্যন্ত ভক্তি ও আনুগত্যের সাথে সেবা করেছিলেন। অনেক ভক্ত এই মন্দিরে ভগবান বজরংবলী এবং মাতা সীতা ও রামের আশীর্বাদ পেতে যান এবং সুস্বাদু লাড্ডু প্রসাদ গ্রহণ করেন।
কিছু কিংবদন্তির অনুসারে, এই মন্দিরটি সেই স্থানটিকে চিহ্নিত করে যেখানে তুলসীদাস ভগবান হনুমানের দর্শন পেয়েছিলেন। এটাও বিশ্বাস করা হয় যে সেই জায়গাতেই তিনি তাঁর মহাকাব্য রামচরিতমানস রচনা করেছিলেন।
এগুলি বেনারসে দেখার মতো কিছু বিশেষ হিন্দু মন্দির এবং ধর্মীয় স্থান।
বারাণসী কেবল তার পবিত্র ঘাট এবং উপাসনালয়ের জন্যই বিখ্যাত নয়, এটি বেনারসি শাড়ি, পান (সুপারি পাতা), স্ট্রিট ফুড এবং সঙ্গীতশিল্পীদের জন্য বিখ্যাত স্থানগুলির মধ্যে একটি।
এটি একটি প্রাচীনতম ও জীবন্ত শহর যা অবশ্যই আপনার জীবনে একবার ঘুরে আসা উচিত।
এরকম আরো ভ্রমণের আর্টিকেল পড়ুন
- গড় পঞ্চকোট (পুরুলিয়া) – কোথায় থাকবেন, কি কি দেখবেন জেনে নিন
- বড়ন্তি (পুরুলিয়া) পশ্চিমবঙ্গ – রিসোর্ট, ঘুরে আসার সেরা সময়
- হাওড়া জেলার ৮টি দর্শনীয় স্থান – পশ্চিমবঙ্গ ভ্রমণ
- অযোধ্যা পাহাড়ের কাছে ঘুরে দেখার ৭টি সেরা পর্যটন কেন্দ্র
- বেনারস শহরের ৭টি হিন্দু ধর্মীয় স্থান যেকানে আপনি ঘুরে আস্তে পারেন
- কলকাতার ৪টি বিখ্যাত হেরিটেজ ক্যাফে যেকানে আপনি ঘুরে আস্তে পারেন