শীত শেষ হয়ে গিয়েছে, বসন্তের এখন শুরু, আর কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে গ্রীষ্মের দাবদাহ।
প্রচন্ড কাঠফাটা রৌদে মন সঙ্গ দেবে না কর্মক্ষেত্রে, তখন মনে হবে কল্লোলিনী শহর থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে সময় কাটায়, ব্যস্ত জীবন থেকে এক টুকরো শান্তির খোঁজে বেড়িয়ে পড়ি
আর গুণগুণ করে গাইতে থাকি,
“মন চলো নিজ নিকেতনেসংসার বিদেশে বিদেশীর বেশে”।
শুধু এরকম ইচ্ছে হলেই তো হবে না, জানতে হবে সেই নিকেতনের খোঁজ, কোথায় গেলে পাবেন এক টুকরো শান্তির খোঁজ।
এইসব ভ্রমণপিপাসু শান্তিপ্রিয় মানুষের জন্য রইল গরমে পশ্চিমবঙ্গ ও তার আসে পশে ঘুরতে যাওয়ার সেরা ৫ টি ঠিকানা…
চলুন এই জায়গা গুলি সম্মন্দে বিস্তারিত ভাবে জেনে নেওয়া যাক…
পশ্চিমবঙ্গ ও তার আসে পশে ৫টি জায়গা যেকানে গরমের ছুটিতে যেতে পারেন
গরমের ছুটিতে পশ্চিমবঙ্গ ও তার আসে পশে যে যে জায়গা গুলি ঘুরতে যেতে পারেন সেগুলি হলো,
১. মিরিক
পাইন গাছের সারি দিয়ে ঘেরা পাহাড়ি গ্রাম হল মিরিক।
মিরিকের নীল জলে ঘন পাইনের ছায়া। চোখে পড়বে কমলালেবুর গাছ। ঠান্ডা পরিবেশে পাখির কলরবে কমলালেবুর গন্ধে আপনার মন প্রাণ নাড়া দেবে।
সকালের নীল মেঘ আর বিকালে সূর্যাস্তের আভায় মনে হবে,” আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব “।
রামিতে দারা ভিউ পয়েন্ট থেকে চোখে পড়বে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া। কি অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করা যাবে না।
এখানে যেন প্রকৃতি মুক্ত বিহঙ্গে উড়ে বেড়াচ্ছে, যেন প্রকৃতির অবাধ স্বাধীনতা।
পাহাড়ের গায়ে চা বাগান গুলো এমন ভাবে রয়েছে, যেন মনে হবে কে যেন পাহাড়ের গায়ে সবুজ রঙের মখমলি চাদর জড়িয়ে তাকে আরো সুন্দর, আরো শোভিত, আরো রূপময় করে তুলেছে।
আর দেরি কেন এমন সুন্দর প্রকৃতির দৃশ্য এর সান্নিধ্য লাভ করতে চলে আসুন পার্বত্য সৌন্দর্যের এই ঠিকানায়। আর নিয়ে যান এক ব্যাগ মন ভালো করার ঔষধ।
কীভাবে যাবেন: দার্জিলিং থেকে মাত্র ১ ঘন্টার পথ মিরিক যাওয়ার। হাওড়া থেকে ট্রেনে করে শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি থেকে সড়কপথে চলে যাবেন মিরিক।
২. সিকিম
প্রকৃতিপ্রেমীদের এ যেন এক দ্বিতীয় স্বর্গ। আলপাইন চারণভূমি, ঝরণা, বুনো ফুল, পাহাড়, ছোটো গ্রাম, চা বাগান, বৌদ্ধ গুম্ফা এই সমস্তের সমন্বয়ে এ এক অন্য জায়গা।
ইচ্ছেই করবেনা নিজের শহরের কোলাহলে ফিরে যেতে। অনবদ্য এই জায়গাতে দু রাত নিমেষেই কাটিয়ে দিতে পারবেন।
তবে এত সুন্দর প্রকৃতির কাছে দু রাত যেন দু ঘন্টার সমান হবে, যেন মনে হবে আরো কিছু মাস এখানেই থেকে যায়। প্রকৃতিকে এত কাছে যে আপনি চলে আসবেন, আপনি নিজেও ভাবতে পারবেন না।
এই সিকিমে রয়েছে নাথু-লা, জেলেপ-লা, চো-লা এবং আরও অনেকগুলি পাস। এছাড়াও এখানে রয়েছে ভারতের ফুটবল তারকা বাইচুং ভুটিয়ার বাড়ি। ঘুরেও আসতে পারেন সেখান থেকে।
সিকিমে রাজ্য ঘিরে রয়েছে তিব্বতী সংস্কৃতি। এখানে গেলেই দেখতে পাবেন অনেক তিব্বতি মনাস্ট্রি। তিব্বতী সংস্কৃতি, তিব্বতী জীবনধারা জানার জন্য এই মনাস্ট্রির কাছে আসতেই হবে।
এই মনাস্ট্রিতে এলে দেখতে পাবেন বৌদ্ধ শিল্পকলা, বৌদ্ধ মন্দির।
বৌদ্ধ মন্দিরে যখন এসে দাঁড়াবেন একটা প্রশান্তি অনুভব করবেন, যেন মনে হবে বৌদ্ধ মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে থাকি ঘন্টার পর ঘন্টা।
আর অবশ্যই ট্রাই করবেন তিব্বতী চা। আহা ঠান্ডার পরিবেশে অন্যরকম নতুন ধরনের চা খাবেন। এ যেন এক সর্গ।
আর যখন আপনি তিস্তার সামনে দাঁড়াবেন, তিস্তার জলের অপরূপ সৌন্দর্য যখন দেখবেন, তখন মনে হবে প্রতিদিনের জীবনের সমস্ত গ্লানি ধুয়ে দিল তিস্তার জল।
অক্লান্ত পরিশ্রমের পর যেমন আমরা বাড়ি ফিরে একটু শান্তির খোঁজ করি, আর সেই শান্তিটা পেতে আমরা চলে যায় নিজের কক্ষে বিশ্রাম নিতে, তেমনি তিস্তার সামনে যখন দাঁড়াবেন তিস্তার জল সেইরূপ শান্তি আপনাকে উপহার দেবে।
তাহলে দেরী কেন এখন থেকেই ব্যাগপত্র গুছাতে থাকুন আর সময় মত চলে আসুন রূপবতী সিকিমের কাছে। একটুকরো শান্তির খোঁজে।
কীভাবে যাবেন: শিয়ালদা থেকে নিউ জলপাইগুড়ি যাওয়ার ট্রেনে উঠবেন। নিউ জলপাইগুড়িতে নেমে গাড়ি করে পৌঁছে যাবেন সিকিমে।
৩. শিলং
শিলং হল উত্তর পূর্ব ভারতের মেঘালয়ের রাজধানী। মেঘালয় হল মেঘের আলয় অর্থাৎ মেঘের বাড়ি। আর এই শিলং নামটা শুনলেই মনে পড়ে যায় শেষের কবিতার সেই কাহিনী।
তবে সেখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না অমিত-লাবণ্য কে। সেখানে খুঁজে পাবেন প্রকৃতির শান্ত শীতল মুগ্ধময় পরিবেশ।
পাহাড়, ঝর্না, জঙ্গলে ঘেরা এই শিলং কে অতীতে বলা হত প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড।
পাইনের ধার দিয়ে যখন হেঁটে যাবেন অমিত হয়ে কিংবা লাবণ্য হয়ে, তখন অমিত হয়ে খুঁজবেন লাবণ্য কে কিংবা লাবণ্য হয়ে খুঁজবেন অমিত কে।
আর যদি আপনি সঙ্গীনী কে নিয়ে যান, তাহলে পাইনের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হবে
‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থী আমরা দুজন চশতি হাওয়ার পন্থি।’
এখানে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের দু দুটো বাড়ি। সেগুলোই ঘুরতে পারবেন। এছাড়াও রয়েছে কাঁচের মত স্বচ্ছ লেক। এই লেকে নৌকা নিয়ে নেমে পড়তে পারেন, মাছের সাথে খেলা করতে।
এখানে দেখতে পাবেন এলিফ্যান্ট ঝর্না, দূর থেকে দেখলে মনে হবে হাতির সুঁর।
শিলং শহর থেকে ২৫ কিমি দূরে রয়েছে মফলং। এই মফলং এ দেখতে পাবেন প্রচুর অর্কিড। সারাবছরই থাকে এখানে পর্যটকদের আগমন।
তাহলে আর দেরী কেন চলে আসুন এই শৈল শহরে, মেঘের সাথে সম্পর্ক গড়তে। আর ব্যাগ ভর্তি মেঘ-আনন্দ এইসব নিয়ে বাড়ি ফিরুন।
কীভাবে যাবেন: হাওড়া থেকে গুয়াহাটি যাওয়ার এক্সপ্রেস ট্রেন ধরে গুয়াহাটি নামুন। সেখান থেকে শিলং যান।
৪. রুপার্ক ভিলেজ
“এই শহর থেকে আরও অনেক দূরে চলো কোথাও চলে যাই ঐ আকাশটা কে শুধু চোখে রেখে মনটাকে কোথাও হারাই। ” এই রুপার্ক ভিলেজে এসে মান্না দের সুরে এই গানটি মনে পড়বেই।
এই রুপার্ক ভিলেজ আর পাঁচটা গ্রামের মত নয়, খুব সুন্দর গ্রাম। গ্রামের পরিবেশ আপনাকে এতটাই মুগ্ধ করবে যে, আর মন চাইবেনা শহরের আধুনিকতাতে ফিরতে।
ওড়িশা রাজ্যের বালাসোর স্টেশনে নেমে ২৮ কিমি দূরেই দেখতে পাবেন পঞ্চলিঙ্গেশ্বর মন্দির। এই মন্দিরের পাশেই রয়েছে ছোট্টো গ্রাম যার নাম রুপার্ক ভিলেজ।
চারিদিকে ঘন জঙ্গলে ঘেরা রয়েছে এই গ্রাম। এখানে মূলত আদিবাসীদের বসবাস। রাত হলেই ভেসে আসবে মাদলের সুর।
এ এক অন্য জগৎ, শহরের কোলাহল থেকে যেন অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। শান্ত স্নিগ্ধ মায়া ভরা এই গ্রাম।
এই গ্রামের মূল আকর্ষণ হল পঞ্চলিঙ্গেশ্বর পাহাড় এবং মন্দির। পঞ্চলিঙ্গেশ্বরে পাহাড়ে যখন সিঁড়ি ভেঙে উঠবেন পায়ে ব্যাথা সেরে যাবে পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের ঝর্ণার জলে। আর এই ঝর্ণার জলে যখন হাত দেবেন অনূভব করবেন শিবলিঙ্গের।
শিবলিঙ্গ কে কিন্তু চোখে দেখতে পাবেন না, কিন্তু অনুভব করতে পারবেন। আর এখানে একটা গহীণ অরণ্য আছে, এখানে দেখতে পাবেন অনেক পশু পাখি।
তাহলে নিরিবিলে শান্ত পরিবেশে দুদিনের জন্য সময় কাটাতে অবশ্যই চলে আসুন রুপার্ক ভিলেজে।
কীভাবে যাবেন: আপনি যদি গাড়িতে আসতে চান ড্রাইভ করে, তাহলে ৫ ঘন্টায় আপনি পোঁছে যাবেন এই রুপার্ক ভিলেজে।
আর যদি ট্রেনে আসতে চান, তাহলে হাওড়া থেকে বালাসোর, বালাসোর থেকে অটো ধরে চলে আসুন পঞ্চলিঙ্গেশ্বরে।
৫) দীঘা
অল্প সময়ের মধ্যে সমুদ্রকে ছুঁতে আপনাকে যেতেই হবে দীঘায়। কলকাতার খুব কাছে মেদনীপুরে অবস্থিত এই দীঘার সমুদ্রসৈকত।
দীঘার গভীর সমুদ্রের পাশে রয়েছে বিরাট ঘন জঙ্গল আর বালিয়াড়ি। সমুদ্রতটে সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে খেলা করে যাচ্ছে শামুক-ঝিনুক।
বিকালের সূর্যাস্তের গোধূলী আভার রং যখন আপনার মুখে লাখবে তখন আপনার মন প্রাণ নাড়া দিয়ে বলবে,
“বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রুপ খুঁজিতে যায় না আর।”
বিকালের হালকা তপ্ত বালুকাবেলায়, মাছ ভাজা খেতে খেতে নদীতটে সঙ্গীনি কে নিয়ে বসে ছলাৎ ছলাৎ সমুদ্রের ঢেউ উপভোগ করার জন্য আসতেই হবে এই দীঘায়।
আর যখন ঝাউবনের পাশ দিয়ে হাতে হাত দিয়ে হেঁটে যাবেন , তখন মনে পড়বে তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই কথা,
“চল রীনা , ক্যাসুরিনা, ছায়া গায়ে মেখে, কাঁকরের পথ দিয়ে একটু একটু করে হারিয়ে যাই, বল যাবে কিনা?”
দীঘার এই রোমাঞ্চকর স্মৃতিকে আরো তরতাজা করতে আরো বেশি করে আজীবন মনে রাখতে, অবশ্যই সংগ্রহ করুন দীঘার কিছু নিজস্ব সম্পদ।
দীঘার সমুদ্রতটে বসে অনেক দোকানের সম্ভার, সেখান থেকে সংগ্রহ করতে পারেন ঝিনুকের কালেকশান। এছাড়াও এখানে বিক্রি হচ্ছে মেদনীপুরের শিল্পীদের হাতের তৈরি মাদুর। আর রয়েছে সামুদ্রিক মাছ। ছোটো ছোটো লাল কাঁকড়া দেখতে পাবেন।
এখানে ২ দিন কাটাতেই পারেন। আর দেরি না করে ব্যাগপত্র এখন থেকেই গুছাতে থাকুন, আর চলে আসুন সমুদ্ররাণীর কাছে।
কীভাবে যাবেন: হাওড়া থেকে দীঘা যাওয়ার জন্য ট্রেন যায়, সেখান থেকে আপনি দীঘায় পৌঁছাতে পারেন। এছাড়াও ধর্মতলা থেকে বাস যায়।
কলকাতা থেকে মাত্র কয়েক ঘন্টা দূরে অবস্থিত এই সমুদ্র নগরী তে আসুন। এসে মনের তৃপ্তি মেটান।
দিঘাতে কি কি দেখবেন ও কোথায় থাকবেন জানতে নিচে দেওয়া আর্টিকেলটি পড়তে পারেন।
দিঘা টুর নিয়ে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন
এই পাঁচটি জায়গা গরমের ছুটি কাটানোর জন্য অনবদ্য। এই গরমে অবশ্যই আসুন এক ব্যাগ শান্তির খোঁজে।
পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে কিছু ওয়েব স্টোরি (Web Stories):
এরকম আরো ভ্রমণের আর্টিকেল পড়ুন
- গড় পঞ্চকোট (পুরুলিয়া) – কোথায় থাকবেন, কি কি দেখবেন জেনে নিন
- বড়ন্তি (পুরুলিয়া) পশ্চিমবঙ্গ – রিসোর্ট, ঘুরে আসার সেরা সময়
- হাওড়া জেলার ৮টি দর্শনীয় স্থান – পশ্চিমবঙ্গ ভ্রমণ
- অযোধ্যা পাহাড়ের কাছে ঘুরে দেখার ৭টি সেরা পর্যটন কেন্দ্র
- বেনারস শহরের ৭টি হিন্দু ধর্মীয় স্থান যেকানে আপনি ঘুরে আস্তে পারেন
- কলকাতার ৪টি বিখ্যাত হেরিটেজ ক্যাফে যেকানে আপনি ঘুরে আস্তে পারেন