Skip to content

কুমারটুলি, কলকাতা – কখন যাবেন, ঠিকানা, কি দেখবেন

আমরা সবাই দুর্গাপূজার সময় এক প্যান্ডেল থেকে আরেক প্যান্ডেল ঘুরে বেড়াই। এটাই একমাত্র সময় যেখানে আমরা আমাদের বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সাথে একটি সুন্দর সময় কাটাতে পারি।

দূর্গা পূজা এমনিতেই বাঙ্গালীদের উৎসব। কিন্তু আপনি কি কখনো জানার চেষ্টা করেছেন যে দুর্গাপূজায় দুর্গা ঠাকুর কেমন ভাবে বানানো হয় বা কোথা থেকে দুর্গা ঠাকুরের মূর্তি গুলি আসে?

আমি গত তিন বছর ধরে কুমারটুলিতে, যেখানে দেবী দুর্গার মূর্তি তৈরি করা হয়, সেখানে যাওয়ার এবং দেখার পরিকল্পনা করছিলাম কিন্তু কোনো না কোনো কারণে আমার পরিকল্পনা ক্যানসেল হয়ে যাচ্ছিলো।

কিন্তু এই বছর আমি কোন না কোনভাবে এই মূর্তিগুলো কিভাবে তৈরি করা হয় তা দেখার জন্য এই কুমারটুলি গিয়েছিলাম।

এই নিবন্ধে, আপনি কুমারটুলি এবং সেখানে আমার ভ্রমণ সম্পর্কে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি জানতে পারবেন,

  1. অবস্থান
  2. খোলা থাকার সময়
  3. যাওয়ার সেরা সময়
  4. ইতিহাস
  5. কি কি দেখতে পাবেন

আসুন এই বিষয়গুলি প্রতিটি বিস্তারিতভাবে দেখে নেওয়া যাক…

কুমারটুলির অবস্থান

ঠিকানাHatkhola, Kolkata, West Bengal – 700005
নিকটতম মেট্রো স্টেশনShobhabazar-Sutanuti
নিকটতম ট্রেন স্টেশনSovabazar Ahiritola
Google Map LocationView on Map

জায়গাটি সোভাবাজার মেট্রো স্টেশন থেকে হাঁটার দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত। আপনি গুগল ম্যাপ ব্যবহার করতে পারেন বা স্থানীয়দের দিকনির্দেশের জন্য জিজ্ঞাসা করতে পারেন।

একটি রবিবারের সকাল আমি এবং আমার এক বন্ধু এই জায়গাটি ঘুরে দেখার জন্য মেট্রোতে উঠেছিলাম।

শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনে নেমে গুগল ম্যাপে লোকেশন দেখতে দেখতে সাত মিনিট ধরে বনমালী সরকার স্ট্রিট হেঁটে গেলাম। পৌঁছে গেলাম কুমোরটুলি।

কুমোরটুলি খোলা থাকার সময়

কুমারটুলির জন্য কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। এটি সারাদিন খোলা থাকে।

আমি আপনাকে ভোরবেলা এটি দেখার পরামর্শ দেব। সকাল ৯টার দিকে আমরা সেখানে পৌঁছাই।

কুমারটুলি ঘুরতে যাওয়ার সেরা সময়

কুমারটুলিতে মা দুর্গার মূর্তি নির্মাণ চলছে

কুমারটুলি দেখার সেরা সময় হল দুর্গাপূজার এক মাস আগে।

এই সময়ের মধ্যে আপনি প্রায়শই ফটোগ্রাফারদের তাদের সেরা ফটো তোলার চেষ্টা করতে এই জায়গায় ঘুরে বেড়াতে দেখতে পাবেন। আমিও আমার ক্যামেরা বের করলাম এবং যোগ দিলাম সেই ভিড় এ।

সেপ্টেম্বরের সকাল হলেও মারাত্মক গরম ছিল কিন্তু তাও এইসব দিয়ে কোনভাবে আমাকে আটকানো যাবেনা তা আমি আগেই জানতাম।

আপনি যেকোন নির্দিষ্ট পূজার আগে কুমারটুলি যেতে পারেন এবং সেই দেব-দেবীর মূর্তি দেখতে পারেন।

যখন আমরা কুমারটুলির গলিতে প্রবেশ করি, আমরা লক্ষ্য করলাম লেনের দুপাশে ওয়ার্কশপ রয়েছে যেখানে কারিগররা বিভিন্ন আকারের হাজার হাজার প্রতিমা তৈরি করতে কঠোর পরিশ্রম করছে।

কুমোরটুলি সম্পর্কে আমার আরও জানার আগ্রহ তখন বেড়ে গেল।

কুমারটুলির ইতিহাস

কুমোরটুলিতে তৈরি হচ্ছে দেবী দুর্গার একটি ছোট ফ্রেম

কুমারটুলি নামটা শুনেই থাকবেন যার অর্থ “কুমোরদের স্থান”। প্রায় ৩০০ বছর পুরানো এই কুমোরদের জায়গাটিতে সর্বপ্রথম কয়েকজন এসেছিল ভালো ব্যবস্থাপনা ও জীবনযাপন করার জন্য।

এখন মোটামুটি এই পাড়ায় ২০০ জন কুমোরের পরিবার থাকে যার উপার্জন হয় মাটির মূর্তি গড়ে। অর্থাৎ ইশ্বরের আগমন আর কুমোরদের উপার্জন।

আমার বন্ধু যখন মূর্তি গুলির ছবি তোলায় ব্যস্ত, আমি কুমোরটুলিতে দেবী দুর্গা প্রতিমার ইতিহাস সম্পর্কে একজন প্রতিমা নির্মাতাকে জিজ্ঞাসা করলাম।

কাদা মাখা হাতে তিনি উত্তর দেন যে তাঁর পূর্বপুরুষরা প্রায় ১৭৫ বছর আগে দুর্গা প্রতিমা তৈরি করা শুরু করেছিলেন।

আমাকে দেখে তিনি বেশ বিস্মিত ও খুশি হলেন। এবং তিনি আনন্দের সাথে স্বীকার করলেন যে, তিনি খুশি বোধ করেছিলেন যে “কেউ তাদের ইতিহাস, সম্প্রদায় এবং কাজ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী”।

এবং তারপর তিনি বললেন..

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে দুর্গা প্রতিমার চাহিদা অত্যন্ত বেড়ে যায়। শীর্ষ প্রতিমা নির্মাতারা ছিলেন নদীয়া থেকে। তাদের পূর্বপুরুষরা দুটি শৈলী “কংশনারায়ণী এবং বিষ্ণুপুরী” অনুসরণ করে দুর্গা মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন।

শৈলীগুলির অনুসারে একটি সাধারণ প্ল্যাটফর্ম ছিল যার উপর দেবী দুর্গা এবং তার পরিবারকে বিভিন্ন আকার এবং উচ্চতার সাথে একই রেখায় নির্মিত করা হয়ে থাকতো।

এই মূর্তিগুলির সজ্জিত চালাগুলি হল কৈলাশী চালা, বৃন্দাবনী চালা, ইন্দ্রাণী চালা এবং ব্রাহ্মণী চালা।

আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে বাঙালী কুমোররা খুব সৃজনশীল ছিল। তারা মূর্তিগুলিকে “একচালা” নামে পরিচিত করেছিল অর্থাৎ একটি মঞ্চে একত্রিত করত দেব দেবীদের অর্থাৎ (মা দুর্গা ও তার চার সন্তানদের)।

আমি একচালা, বা একক প্ল্যাটফর্ম এ দুর্গা পূজার ধারণাটি বুঝতে পেরেছিলাম। 

দেবী দুর্গার একটি মূর্তি নির্মাণ করা হচ্ছে

পাল কুমোরের বর্ণিত গল্পে আমি বেশ মগ্ন ছিলাম অনেকক্ষণ, মন দিয়ে শুনছিলাম এই সমৃদ্ধ ইতিহাস। তিনি আমাদের যতীন্দ্রনাথ পাল এবং নিরঞ্জন পালের মতো বিখ্যাত প্রতিমা ও মূর্তি নির্মাতাদের কথাও বলেছিলেন।

তিনি এও বললেন তাদের বানানো অপূর্ব দুর্গা ঠাকুরের মূর্তি গুলো সাবর্ণ রায় চৌধুরী, সোভাবাজারের দেব, দর্জিপাড়ার মৈত্র এবং হাটখোলার দত্তের মতো ধনী জমিদারদের বোনেদিবাড়ি পূজাতে গৃহীত করা হয়েছিল।

সেখানে আমাদের কথোপকথন শুনে একজন কারিগর বলেছিলেন যে পুরানো দিনের দেবী দূর্গার উজ্জ্বল হলুদ রঙের বর্ণ এবং রাঙা চোখ দিয়ে একটি ঐতিহ্যবাহী এবং কমনীয় চেহারা বোঝায়। তিনি আরও বলেন, “টানা টানা চোখ জেনো মাতৃশক্তির আধার” (প্রশস্ত লম্বা চোখ নারীর  শক্তির প্রতীক)।

দেবী দুর্গা ও লক্ষ্মীকে সাধারণত হলুদ রঙে, সরস্বতীকে সাদা রঙে এবং মহিষাশুরকে সবুজে আঁকা হতো। খড়ের গাদায় পরে থাকা একটা ঘোড়ার মূর্তি (এটা অনেকটা একটা অর্ধ-ড্রাগনের মতো দেখতে)। আমি সেটার দিকে ইশারা  করে কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করলাম “ঘোড়া কোন দেবতার বাহন”?

সেখানে একটি ছোট শিশু হেসে উত্তর দিল, এটা ঘোড়া বা ড্রাগন নয়, এটা সিংহ এবং দেবী দুর্গার বাহন। আমি বেশ হতবাক হলাম!

পাল বাবু উত্তর দিলেন, রাজবাড়ীরা হলুদ রঙের মূর্তি, সবুজ অসুর, ড্রাগন-সদৃশ সিংহ দিয়ে দুর্গা পূজার চিরন্তন আকর্ষণ এবং নৈসর্গিক সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে বারংবার।

তিনি আরও বলেন, বাগবাজার সার্বজনীন মূর্তিটি দেখতে গেলে এই পুরানো স্টাইলের মূর্তি দেখতে পাবো যা কলকাতার অন্যতম স্বাক্ষর প্রতিমা হিসেবে বিবেচিত হয়।

ভগবান গণেশের গায়ে রং দিতে গিয়ে তিনি বলেন, একচালা মূর্তি নকশায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। এখন পাঁচলা (একটির পরিবর্তে পাঁচটি পৃথক প্ল্যাটফর্ম) মূর্তি ভাস্কর্যের নতুন উপায় হিসাবে বিবেচিত হয়। এখন যে মূর্তি তৈরি হয়েছে তা মায়ের ভয়ঙ্কর মূর্তির বদলে মানুষের মুখমণ্ডলের মতো তৈরি করা হয়েছে।

দেবী দুর্গার মানব-সদৃশ মূর্তি ভক্তদের মন জয় করে, যদিও এই পরিবর্তনটি কুমোরদের জন্য বেশ কঠিন ছিল। দূর্গা দেবীর প্রতিমা তৈরির ঐতিহ্যবাহী এবং সমসাময়িক শৈলীর গল্প সত্যিই আমার হৃদয় স্পর্শ করেছিল।

কুমোরটুলিতে কি কি দেখতে পাবেন

দেবী দুর্গার মূর্তির মুখ নির্মাণ করা হচ্ছে

আমি যখন সেখানে ছিলাম, কিছু মূর্তি দেখতে একই রকম ছিল, অন্যগুলো সম্পূর্ণ অনন্য এবং থিম-ভিত্তিক।

পূজার মরশুমে ভারতের বহু জায়গা থেকে কারিগররা আসে কুমারটুলিতে তাদের কাজ প্রদর্শন করার জন্য।

কুমারটুলি থেকে অনেক প্রতিমা এবং বিগ্রহ বাইরে এবং বিদেশে পাঠানো হয়।

এই মূর্তি গুলো পরিবেশের খেয়াল রেখেই বানানো হয়ে থাকে। এই পদ্ধতি সত্যিই অনবদ্য পরিবেশ দূষণ ও বেশি করে জলের দূষণ প্রতিরোধ করার জন্য।

প্রায় বিকেল হয়ে গেছে, আমাদের ফিরতে হবে তাই অনেক কুমোরদের ধন্যবাদ জানিয়ে, না শোনা গল্প আর অজানা ইতিহাস নিয়ে আমরা বাড়ি ফেরার পথে রওনা দিলাম।

আমি সত্যিই কুমোরটুলির সুন্দর সম্প্রদায়কে অনেক কাছ থেকে দেখলাম ও জানলাম এবং কুমোরদের সূক্ষ্ম এবং ত্রুটিহীন কাজের প্রশংসাও করলাম।

আপনি যদি নতুন জায়গায় ঘুরতে চান এইসব পুরনো সুন্দর অতীতকালে জায়গাগুলো ঘুরে আসুন, তাতে মন ভালো হবে এবং আপনি অনেক কিছুর বিরল দৃশ্যের সন্ধান ও পাবেন।


পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে কিছু ওয়েব স্টোরি (Web Stories):


এরকম আরো ভ্রমণের আর্টিকেল পড়ুন